top of page

চেনা অচেনা বক্সা জয়ন্তী (চতুর্থ অধ্যায়)

Writer: Jayanti RiverviewJayanti Riverview

Updated: Mar 18, 2021

তাশিগাঁও থেকে জয়ন্তী


|| প্রথম পর্ব ||

‌আজ আমাদের অভিযানের তৃতীয় এবং শেষ দিন। তাশিগাঁও ও ফুবা কাকুর থেকে বিদায় নেবার পালা। দুদিন কাকুর বাড়ি থেকে একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্যাগ ও টেন্ট প্যাক করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল। কাকু আমাদের থেকে থাকা খাওয়া বাবদ লাভ করা তো দূর এতটাই কম মজুরি চাইল আমাদের কাছে অকল্পনীয়। আমরা খুশি হয়ে কিছুটা বেশিই দিয়ে দিলাম। কাকু আমাদের দিলেন বুক ভরা ভালোবাসা, নিরলস আতিথেয়তা আর পিতৃস্নেহ যার কাছে সমস্ত টাকার অঙ্ক অসংজ্ঞাত হয়ে পড়ে। কাকুর থেকে বাড়তি প্রাপ্তি বলতে আমার মতো মুদ্রা সংগ্রহবাতিকের দুটি ভূটানের এক ও দশ টাকার নোট লাভ। ঠিক আটটার সময় কাকুর বাড়ির সামনে সবাই একসাথে ছবি তুলে, কাকু কাকিমাকে প্রণাম করে বিদায় জানিয়ে আমরা লেপচাখার পথ ধরলাম। যদিও প্রথমে আমরা লেপচাখা না গিয়ে অসলুম গ্রাম ঘুরতে যাব। অসলুম স্থানীয় লোকজনের মুখে ‘ওচুলুং’ শোনায়। প্রথমে তাশিগাঁও থেকে বেশ কিছুটা উতরাই ঘুরে ঘুরে নামতে হল। এই সময় পথের দুপাশে চাষের জমি দেখলাম। পথে একটা বাঁকে বিশ্ব পিছিয়ে ছিল বলে পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখি উপর থেকে ফুবা কাকু হাত নেড়ে টাটা করছেন। মুহূর্তে আমার চারপাশের পৃথিবীটা থমকে গেল। মানুষটা দুদিন আগেও আমাদের চিনতেন না। আজ উনি নিজের কাজ ফেলে ঘর থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে আমাদের বিদায় জানাচ্ছেন এবং ওনার বিশ্বাস আমরা একবার ফিরে তাকিয়ে ওনাকে দেখবই। সত্যি পাহাড়ের মানুষ এতটা ভালো হয়? উতরাই পথ নেমে আসার পর একটা জায়গায় দুটো রাস্তা ক্রিসক্রস হয়ে গেছে। ডানদিকে গেলে লেপচাখা। আমরা বাঁদিকে নেমে এলাম। একটা এক কামরার বাড়ি চোখে পড়ল সামনেই। মালিকবিহীন তালাবন্ধ বাড়ির দালানে স্যাক দুটো রেখে রওনা দিলাম দূরে পাহাড়ের গায়ে অসলুম গ্রামের উদ্দেশ্যে। পাকদন্ডী বেয়ে কিছুটা নেমে আসার পর পথ প্রায় পুরোটাই হালকা চড়াই উতরাই মেশানো। পাহাড়ের গা দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়ে একটা সরু ঝর্ণায় জল খেয়ে উঠে এলাম নতুন গড়ে ওঠা অসলুম গ্রামে। গ্রামের লোকেদের থেকে জানলাম পুরোনো অসলুম গ্রাম যেতে হলে আরো মিনিট পনেরো যেতে হবে। পুরোনো গ্রামে বাড়ির সংখ্যা বেশি। আমরা পৌঁছাতেই পাহারাদার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে স্তব্ধতা ভঙ্গ করল। কয়েকটি বাড়ি পেরিয়ে উঠে এলাম একটি বৌদ্ধস্তূপের কাছে। একটু জিরিয়ে নেওয়া গেল। ফিরতি পথ ধরেছি পাঁচ মিনিটের মাথায় খেয়াল হল সানগ্লাসটা মিসিং। মনে করে দেখলাম, ওই বৌদ্ধস্তূপের উঠোনে বিশ্রামের সময় ওটা খুলেছিলাম। আবার আনতে ছুটলাম, বিশ্ব ওখানেই বসে বসে মিটমিটিয়ে হাসছে। চড়াই ভেঙে আবার উঠতে খুব বিরক্তিকর লাগছে, আর সাথে পনেরো মিনিট সময় নষ্ট। এক দৌড়ে ঠিক পৌনে দশটা নাগাদ আমরা ফিরে এলাম সেই বাড়িতে। হঠাৎই আবিষ্কার করলাম এতো আমাদের গাইড কাকুর বাড়ি। বারান্দায় কচি বাঁশের লাঠিটা তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। এর জোড়াটা ছিল বিশ্বর কাছে। উনি সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে যান সিঞ্চুলার দিকে তাই দেখা হয়নি। পরিচিত মানুষের বাড়ি পেয়েছি। সেই আনন্দে পাঁচ মিনিট অতিরিক্ত বিশ্রাম নেওয়াই যায়।






|| দ্বিতীয় পর্ব ||

গাইড কাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম বক্সা অঞ্চলের সবথেকে জনপ্রিয় পাহাড়ি গ্রাম লেপচাখা। পাহাড়ের একদম মাথায় অবস্থিত এই গ্রামের চোরতেনগুলো আমরা রোভার্স পয়েন্ট থেকে দেখেছি, অসলুম থেকে দেখেছি। এইবার একদম নাগালের মধ্যে এল। লেপচাখায় একরাত থাকব এমনটাই প্ল্যান আমরা করেছিলাম কিন্তু আধুনিকভাবে হোম স্টে দ্বারা সজ্জিত লেপচাখা এখন টুরিস্ট স্পট, সেখানে টেন্ট পিচ করার অনুমতি পাওয়া যাবে না এ কথা আমাদের ফুবা কাকু বলেছিলেন। আমরা আমাদের গাইড কাকুকে বলেছিলাম তাঁর বাড়িতে যদি থাকি তাহলে কেমন হয়? উনি বললেন, ওনার বাড়িতে গিয়ে লাভ নেই, ওটা লেপচাখা থেকে নীচে আর খাবারের আয়োজন করতে আমাদের লেপচাখায় যেতে হবে। উপায় নেই দেখে আমরা তাশিগাঁওতেই কাল রাতটা থেকে গিয়েছিলাম। লেপচাখার চোরতেনগুলো অর্থাৎ বৌদ্ধস্তূপগুলো দেখবার মতো। এর ঠিক ডানদিক থেকে শুরু হয়েছে পর পর হোম স্টে। কাল যে কোলকাতা থেকে আসা অর্ধশতজনের দলটি দেখেছি, তারা রাত্রে এখানে ছিল এবং আজ পৌঁছে ওদের সাথে দেখা হল। দশটা পনেরো বাজে। ঠিক পনেরো মিনিট সময় নিলাম ফোটো, ভিডিও ও জলপান বিরতির জন্য। এই প্রথম ডুয়ার্সের এত পরিস্কার ভিউ পেলাম। ডিমা আর কালজানি নদী এঁকেবেঁকে সমতলে বয়ে গেছে, দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। জীবনটাও তো এমন করেই এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে, সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হতে। তবে মনঃসংযোগের উপায় নেই আর এত মানুষের ভিড়ে লেপচাখা কোলকাতার ধর্মতলা হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়া যায় ততই মঙ্গল। আমরা যাব কাটলুম হয়ে জয়ন্তী। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে লেপচাখা থেকে মহাকাল পর্যন্ত দূরত্ব তেরো কিলোমিটার। চোরতেনগুলোর বাঁদিক দিয়ে একটা রাস্তা নীচের দিকে চলে গেছে, সেটা ধরলাম। পথে দুজন স্থানীয় বাসিন্দা আমাদের সাবধান করে দিলেন, সামনে রাস্তা দুটো ভাগে ভাগ হয়েছে। আমাদের বামদিকেরটা ধরতে হবে, ডানদিকেরটা জঙ্গলের রাস্তা। একটা স্ত্রী কুকুর আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল। পরে তার ছোট ছোট বাচ্চারাও যোগ দিল। উতরাই রাস্তা ; আমরা দৌড়াচ্ছি, ওরাও দৌড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হতো আমাদের কুকুর তাড়া করেছে। এবার শুরু হল পাকদন্ডী বেয়ে খাঁড়া পথে নেমে যাওয়া। স্যাক কাঁধে নামছি তাই দাঁড়াতে চাইলেও পা দুটো ব্রেক মানছেনা। থামতে কষ্ট হচ্ছে দেখে আর থামলাম না। একটু পর কুকুর বাচ্চাদের আর দেখা গেল না, ওদের মা একাই আমাদের সাথে আছে। পথে আবার লোক দেখা গেল। বিশ্বকে বললাম, গাইডের কথা জিজ্ঞেস করলে এই সারমেয়কে দেখিয়ে দিবি। দুটো বাঁক নেমে দেখলাম এরা সেই লোকগুলো যাদের সাথে রোভার্স পয়েন্ট যাওয়ার সময় প্রথম দিন দেখা হয়েছিল। আমাদের বলল, আজকেও গাইড নেই? রাস্তা চেনা তো? আমরা বললাম, হ্যাঁ, চেনা পথ, ওইতো নেমে নদী ধরে মহাকাল পৌঁছে যাব। বললেন, ঠিক আছে, সাবধানে যাও, এত জোরে দৌড়িও না। আমরা গতি কমিয়ে নিলাম যতক্ষণ ওদের চোখের নাগালে আছি। কতগুলো বাঁক এইভাবে নেমে এলাম মনে নেই, শুধু মনে মনে বললাম, এই পথে কেউ লেপচাখা উঠতে বললে আমি কোনওদিন উঠতে চাইব না। এসে পৌঁছলাম একদম নীচে কাটলুম নদী গর্ভে। দেখলাম একজন মহিলা কাপড় কাচছে নদীর পাড়ে বসে আর তাঁর বাচ্চা ছেলেটা পাশে বসে আছে। আমরা পথ জিজ্ঞেস করতে বললেন, নদীর গতিপথ ধরে হেঁটে চলে গেলেই হবে।




লাবণ্যময়ী লেপচাখা

কাটলুম নদী গর্ভ


|| তৃতীয় পর্ব ||

আমরা কাটলুম গ্রামের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললাম। গ্রাম বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা, কারণ এখানে মাত্র দুই তিনটে বাড়ি আছে। এখানে বসবাসকারী মানুষের প্রধান কাজ সম্ভবত নদীর মাছ ধরা। আমাদের গন্তব্য মহাকাল অনেক দূর তাই সময় নষ্ট না করে গতি বাড়িয়ে নদীগর্ভ ধরে চলতে থাকলাম। খরস্রোতা কাটলুম নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে নদীগর্ভ আসলে ছোটো বড় পাথরে ভরা বোল্ডারজোন। পথ নির্দেশ নেই তাই মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবতে হচ্ছে কোন জায়গা দিয়ে চলতে হবে। আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে ছোট বোল্ডারগুলো পার হচ্ছিলাম যদিও পিঠে রূকস্যাকের ভারে সেই লাফ কিছুটা হলেও খাটো হয়ে যাচ্ছে। দুদিকে খাঁড়া পাহাড়ের দেওয়াল মাঝখান দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি। নদী কিছুদূর অন্তর বাঁক নিয়েছে তাই কতদূর এসেছি আর কতটা বাকি বোঝা মুশকিল। জীবনে অনেক বিপদে পড়েছি কিন্তু আত্মবিশ্বাস কখনো এতটা হারাইনি। আমাদের দুই তিন মিনিট অন্তর নদীর এপার থেকে ওপার করতে হচ্ছে, প্রকৃতি মা যেন সেভাবেই একটা পাজ্ল বানিয়ে দিয়েছেন। আর নিখুঁত স্টেপ না পড়লে পতন অবধারিত। আমার পিঠের বোঝাটা বড় ভূমিকা পালন করল এক্ষেত্রে। যতবার নদী পার হতে গিয়ে লাফ দিতে যাই ততবারই পিছনে টেনে রাখছে। বিশ্ব আগে আগে চলছে; কি সাবলীল ওর চলার ভঙ্গি আর আমি শুধু ভাবছি এই বুঝি পড়ে গেলাম। বামদিক থেকে আরেকটি ধারা এসে মিশল, নদী ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। এখন আর এক লাফে পেরোনো সম্ভব না। এবার হলো আরেক মুশকিল। এদিক থেকে ওদিক যেতে অন্তত তিনটে পাথরে পা রেখে পেরোতে হচ্ছে, পাথরগুলোর মধ্যে এমনই ব্যবধান লাফ দিয়ে দিয়েই এগোতে হবে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু যখনই দেখলাম কিছু পাথরের উপরটা ভেজা আর পিচ্ছিল আমি প্রমাদ গুনলাম। বার তিনেক ভেজা পাথরে পিছলে পড়তে হল, দুবার পাথর সরে গিয়ে জলে ধপাস করে পড়লাম। এইভাবে চলতে থাকলে দেরি হয়ে যাবে, বীতশ্রদ্ধ আর নিজের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে জুতো খুলে ফেললাম। পায়ে গলালাম বিশ্বর কিটোজুতো আর নদী পারাপারগুলো খালি পায়ে করতে থাকলাম। যদিও এতে গতি বিশেষ বাড়ল না কারণ এই কিটোজুতো পড়ে ডাঙায় বোল্ডারের উপর পিছলে যাচ্ছি। ক্লান্তি আর খিদে এর সাথে যোগ দিল। বারোটা বাজতে আমরা এক জায়গায় বিশ্রাম নিতে বসলাম। খেতে গিয়ে দেখলাম চিঁড়ের প্যাকেট ফেলে এসেছি। ছাতু আর গুড় অল্প জলে গুলে এক কাপ করে খেয়ে নিলাম। সঙ্গে যে পানীয় জল ছিল তা প্রায় শেষ। একবার ভুল করে ফোনে অফলাইনে গুগল ম্যাপটা খুলেছি আর চক্ষু চড়কগাছ। দেখলাম আমরা দুই ঘন্টা ধরে যতটা এসেছি তা বাকি রাস্তার পরিমাণের তুলনায় নগণ্য। বিশ্ব যদিও বলল, দুটো নাগাদ মহাকাল পৌঁছে যাব। নদীর উচ্চগতি ধরে হাঁটার সৌভাগ্য আগেও হয়েছে কিন্তু নদীগর্ভের মধ্য দিয়ে নয়। এ যেন একটা গেম খেলছি। ভুল স্টেপ নিলেই গেম ওভার হয়ে যাবে। একেক সময় এত উঁচু বোল্ডারের সামনাসামনি চলে আসছি যে সেগুলো ক্লাইম্ব করে পেরোনো ছাড়া উপায় নেই। এইভাবে চলতে চলতে একটা ‘Y’ আকৃতির অংশে পৌঁছলাম যার একদিক দিয়ে আমরা এগোচ্ছি আরের দিক দিয়ে আরেকটি ধারা সোজা পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। দুটো ধারা মিশে একসাথে প্রবাহিত হয়েছে জয়ন্তী নদী। গুনে গুনে সাতটা পাথরের উপর সাবধানে পা ফেলে শেষবারের মতো ব্রিজ ছাড়া পেরোতে হল নদী। দুটো ধারার সঙ্গমস্থলে নদী একটু চওড়া আর গভীর। স্বচ্ছ সবুজ-নীল জল আর তলদেশে রঙিন পাথর আমাদের আকৃষ্ট করছে। বিশ্ব হঠাৎ ব্যাগ ফেলে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে বলল, গামছা দাও স্নান করব, দুদিন করিনি, আজ এখানেই করব। আমি রাজি হচ্ছিলাম না হাতে সময় নেই বলে। কিন্তু নিজেকেও আটকে রাখা কঠিন হল। নেমে পড়লাম বরফঠান্ডা স্রোতস্বিনী নদীতে কোমর জলে। জলে পা পড়তে কারেন্ট খেয়েছিলাম বটে কিন্তু পা সরানোর আগেই পিছলে জলে পড়ে গেছি তাই নামতে বেগ পেতে হয়নি। স্নান করে শরীর মন চাঙ্গা হল আর পেলাম ফ্রিতে ফিস থেরাপি। দুই পায়ে ছোট ছোট মাছ কামড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে পেডিকিয়োর করে দিচ্ছে। জল থেকে উঠে ঝলমলে রোদে যখন গা শুকাচ্ছি তখন দূরে দেখলাম ওই দুই ভদ্রলোক তাঁদের দুই গাইডের সাথে এদিকে আসছেন। আমরা নির্জনতা ভালোবাসি তাই তড়িঘড়ি রেডি হয়ে আবার এগিয়ে চললাম। এইবার দেখলাম নদীর গভীরতা আর স্রোত বাড়তেই নদীর উপর অস্থায়ী সেতু নির্মিত হয়েছে। আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল। এবার প্রায় দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে চললাম। নদীর জলের নীলচে সবুজ রং আর দুধারের সবুজ পাহাড়ের দেওয়ালের শ্যামলিমায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। একটা নব্বই ডিগ্রি বাঁক এল। নদী ডানদিকে বেঁকে গেছে। আমরা বামদিক থেকে সেতু পেরিয়ে ডানদিকে এসে বোল্ডারের উপর উঠে এলাম। সোজা তাকিয়ে দেখলাম এ এক অন্যরকম প্রকৃতি। কেউ যেন বড় বড় বোল্ডার নদীখাতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। মিনিট পাঁচেক পর কিছু লোকজন দেখতে পেলাম আর দেখলাম ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে একটি প্রবেশদ্বার। মহাকাল মন্দির যাওয়ার রাস্তা। নদীর এপারে ভারত ওপারে ভূটান। লোকজনকে দেখলাম তারা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে আচ্ছন্নের মতো এগিয়ে চলেছে, দেখা হলেই একে অপরকে ‘জয় মহাকাল’ বলে উঠছে। আমাদের অনেকেই জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোথা থেকে আসছি। লেপচাখা বললে ভালো হতো, কারণ তাশিগাঁও বলতেই তারা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে কারণ শখের ভ্রমণকারীদের কাছে এই দূরত্বটা স্বাভাবিক নয়। মহাকাল পর্যন্ত যে নির্জনতা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে এসেছি তা কর্পূরের মতো উবে গেল। স্থানে স্থানে অস্থায়ী ছাউনি ও থাকার ব্যবস্থা চোখে পড়ল। আমরা এবার যাব জয়ন্তী। আর মাত্র আট কিলোমিটার। ঘড়িতে দুটো বাজছে। হাতে সময় থাকলে মহাকাল মন্দির দর্শন হতে পারত। মনে মনে বললাম, মহাদেব খুব শীঘ্রই আবার এখানে আসব।





মহাকাল মন্দিরের প্রবেশ পথ, ভূটান


|| চতুর্থ পর্ব ||

ট্রেনে জানলার ধারে একটা জায়গা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সারারাত জেনারেল কামরায় ঘুম যে হবে না তা জানি, কিন্তু বাইরেটা দেখতে দেখতে যেতে তো পারব। গত কয়েক ঘন্টা যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। সরকারি বাসে চেপে জয়ন্তী থেকে অভিযান শেষে ফিরছিলাম। বাস নামিয়ে দিল আলিপুরদুয়ার জংশনের সামনে। নাচতে নাচতে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে শিয়ালদার টিকিট চাইলাম। উত্তর এল, আজ আর ট্রেন নেই, চারটের সময় ছেড়ে চলে গেছে। আমি অ্যাপে দেখছি পদাতিক এক্সপ্রেস পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ছাড়বে। অঙ্কটা তো মিলছে না। পাশে এক টিটি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন; বললেন, তুমি ভুল স্টেশনে এসেছ। নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে পদাতিক ছাড়বে। সবে পাঁচটা বাজে, অটো ধরে বেরিয়ে যাও এখন। বুঝলাম দুটো স্টেশন একটা ওল্ড একটা নিউ। এই স্টেশনের ট্রেনগুলো শিলিগুড়ি থেকে সেবক, হাসিমারা, রাজাভাতখাওয়া হয়ে যায়। আর নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেনে চাপলে নিউ কোচবিহার, মাথাভাঙা, ফালাকাটা এই স্টেশনগুলো আসে। ডুয়ার্সের উপর দিয়ে একটা লাইন, নীচ দিয়ে আরেকটা লাইন। ভাগ্যক্রমে সঙ্গে সঙ্গে একটা অটো ধরে নিউ আলিপুরদুয়ার পৌঁছে গেলাম মাত্র পাঁচ মিনিট আগে। মহাকাল মন্দিরের প্রবেশদ্বার ছাড়িয়ে এগোতেই দেখলাম বেশ কয়েকটি সাঁকো এখানে নির্মাণ করা হয়েছে যাত্রীদের সুবিধার্থে। এগুলো পেরিয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পর পেলাম খাবারের দোকান। ব্যাগে পানীয় জল শেষ, তাই দোকানে দাঁড়িয়ে অনেকটা জল খেয়ে আবার এগোতে শুরু করলাম। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল এত লোকজন দেখে। লোকজন ঝাঁচকচকে পোশাক পড়ে দলে দলে হেঁটে এদিকে আসছে, আর আমরা রিফিউজির মতো পিঠ বোঝাই মালপত্র নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে চলেছি। আমার হাতে ঝুলছে আমার ভেজা বুটজুতো। বিশ্বকে বললাম, একদিকে ভালোই হল, এমন বেশে থাকলে মেয়েরা নজর দেবে না। যদিও নারীপুরুষ নির্বিশেষে লোকজন আমাদের অদ্ভুত বেশভূষা নিরীক্ষণ করতে করতে যাচ্ছিল। জয়ন্তী নদীর রূপ যৌবন দেখে মনে যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম, ততটাই কষ্ট হল পাহাড়ে ছেড়ে সমতলে নামার পর। পাহাড়কে বারংবার পিছন ফিরে বিদায় জানাচ্ছি, আবেগে হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে আসছে। সামনে এখন দিগন্ত বিস্তৃত নুড়ি পাথর ছড়ানো উলঙ্গ জমি। এর মাঝখান দিয়ে সরু সুতোর ন্যায় বয়ে চলেছে জয়ন্তী। আমার পাহাড়ি নদী দেখার অভিজ্ঞতা কম। অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি এই নদীর এত ক্ষমতা যে কয়েক কিলোমিটার চওড়া এর নদীখাত। বর্ষাকালে এই নিরীহ নদীই দৈত্যাকার রূপ ধারণ করে দুকূল ছাপিয়ে বয়ে যায়। কিটোজুতো ছেড়ে বুট পড়ে নিলাম যার তলার সোল সামনের দিক খুলে হাঁ হয়ে রয়েছে। কোনোরকমে কষ্ট করে হেঁটে নুড়ি পাথরে ভরা নদীখাত ছেড়ে ডানপারে এসে উঠলাম। বাড়ি ঘর, হোটেল, হোম স্টে দেখে বুঝলাম জয়ন্তী পৌঁছে গেছি। ঘড়িতে তিনটে বাজে। জয়ন্তী হাই স্কুল পেরিয়ে কিছুদুর আসতেই বাসস্ট্যান্ডে আমাদের বাস চোখে পড়ল। পরবর্তী অভিযানের প্ল্যানিং করার সময় হয়েছে।


পাহাড় তোমাকে বিদায়

জয়ন্তী নদীগর্ভ




 

Writer and Explorer: Soumik Maiti

He is a private tutor by Profession and his aim in life is to explore the world.

Original blog: Click here => Bong explorer




 
 
 

Comments


bottom of page